শাদা, কালো ও সবুজ বিপ্লব : মুসলমানদের রাজনৈতিক সংঘাতে রঙ ও রঙের ধর্মীয় হাকিকত
রাজনীতি


‘বয়ানের রঙ হইতেছে এক শাব্দিক অলঙ্কারিক সাজ, রঙ বয়ানের গায়ে চরে যায়, বয়ানের বার্তাকে সাজসোজ্জা দেয়, ফলে বয়ান প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠে’— রোমের বিখ্যাত বক্তা মার্কাস সিসেরো তার রেটোরিকাল ক্রিয়েটিভিটির উপর একখানা বহস প্রবন্ধে এই কথা বলেন। এইখানে তিনি রঙকে শব্দের সঙ্গে তুলনা করেন নাই, শব্দকে রঙের সঙ্গে তুলনা করছেন, কারণ শব্দের গায়ে রঙ চড়ার ফলেই সে সাজসোজ্জা পায়; এইখান থেকে বোঝা যায়, রঙ সেই প্রাচীন যুগেও মানুশের উপর কতটা প্রভাববিস্তারী ছিল।
মধ্যযুগে রঙের প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, কেউ কেউ রঙকে শয়তানের অস্ত্র মনে করত, যে, মানুশকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলার মাধ্যম এটা; আবার কেউ কেউ রঙকে পবিত্র ভাবত, এই হিশেবে যে, রঙ হচ্ছে খোদায়ি আলোর ফল, দুনিয়াকে আলোকিত করে— এই দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করছেন হেরমান ব্লাই তার শয়তানী রঙ ও পবিত্র রঙ গবেষণাপত্রে।
এই যে পরস্পর বিরোধী দুই জিনিশ—পবিত্রতা ভার্সেস শয়তানি—খুব জোরালোভাবেই হাজির ছিল শুরুর যুগগুলাতে মুসলিমদের মধ্যে, রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংঘাতে রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রে; কারণ রাজনৈতিক সংঘাতগুলায় সবসময়ই সমাজের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মানসিকতার গভীর ছায়া পড়ে। এইটা খাস করে আমরা দেখতে পাই উমাইয়া ও আব্বাসি আমলে। নিচে তফসিলের সহিত এই নিয়ে আলাপ দেওয়া গেল :
উমাইয়াদের শাদা রঙ : ইসলামি বিশ্বাসের প্রতীক
যখন নবী মুহাম্মদ সা. মক্কা বিজয় করতেছিলেন, তখন উনার বাহিনীর পতাকা ছিল শাদা; এই খবর পাই আমরা আন-নুয়াইরির নিহায়াতুল আরব (১৪২৩ হি.) কেতাব থেকে। পরবর্তীতে উমাইয়া খেলাফতের সময়েও শাদা ছিল রাষ্ট্রের প্রতীকি রঙ, এবং উমাইয়াদের বলা হইত ‘আল-মুবাইযা’, মানে শাদা রঙধারী।
এই শাদা রঙ উমাইয়াদের জন্য দুইটা মৌলিক শর্ত পুরা করছিল— এক. আরবদের মাঝে শাদা রঙের প্রতি আগ থেকেই থাকা মানসিক একটা আস্তা ও ভালবাসা— কারণ আরব কালচারে শাদা রঙ চিরায়তই প্রিয় ও পছন্দিদা ছিল; আর জানাই যে, উমাইয়া ছিল পষ্টভাবেই আরব-চেতনার ধারক। দুই. শাদায় ছিল ধর্মীয় মর্যাদা ও পবিত্রতার প্রতীকী।
আরবরা যেকোনো ভালো জিনিশকেই শাদার সঙ্গে তুলনা করত। তারা বলত : শাদা হাত (মানে, দানশীলতা), শাদা মন (মানে, পবিত্র অন্তর)। শাদা ছিল দানশীলতার রঙ, পবিত্রতার রঙ— এমনকি ইজ্জতের পবিত্রতা বোঝাতেও এই রঙ ব্যবহার হত।
এইটা দিনের রঙ, রৌদ্রোজ্জ্বল সূর্যের রঙ। আর যখন পূর্ণিমার রাতে চাঁদ ফোটে শুরু থেকে শেষতক, তখন আরবেরা সেই রাতগুলারেও বলে— শাদা রাত। তাছাড়া হাজীরা যখন কাবায় যায় হজে, তখন তারাও শাদা কাপড় (এহরাম) পরে, এবং এইটাও শাদার ধর্মীয় দিক তুইলা ধরে— এই ব্যাপার ড. আহমদ মুখতার ওমর বলছেন উনার আল-লুগাহ ওয়াল-লাওন (২০০৭) কেতাবে।
–----
যখন নবী মুহাম্মদ মক্কায় প্রবেশ করলেন, উনার বাহিনীর পতাকা ছিল শাদা। এই রঙ কুরআনে সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত রঙগুলার একটা; শাদা শব্দটা কুরআনে আসছে ১২ বার। শাদা রঙ ছিল বুরাকের রঙ—সেই পশু যার পিঠে করে নবীজী মিরাজ সফর করেন। এইটা হাউজে কাওসারের রঙ, যেখান থেকে কেয়ামতের দিন ঈমানদারদের নবীজী পানি খাওয়াবেন। শাদা জান্নাতবাসীদের মুখের রঙ, ইসলামি বিশ্বাসের রঙ শাদা— ‘আমি তোমাদের রেখে যাইতেছি এক শাদা সরল পথের ওপর।’
ধর্মীয় পবিত্রতার দিক থেকে : শাদা রঙ কুরআনে সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত রঙগুলার একটা; শাদা শব্দটা কুরআনে আসছে ১২ বার, যেমনটা উল্লেখ করছেন ড. হানান আব্দুল ফাত্তাহ মুতাউয়ি উনার ইসলামি তেহযিবে রঙ ও তার তাৎপর্য গবেষণাপত্রে; এইটা হাউজে কাওসারের রঙ, যেখান থেকে কেয়ামতের দিন ঈমানদারদের নবীজী পানি খাওয়াবেন; এইটা জান্নাতবাসীদের মুখের রঙ— কুরআনে আলে ইমরান সূরায় আছে : ‘আর যারা শাদামুখ হবে, তারা থাকবে আল্লাহর রহমতে।’ সূরা সাফফাতে আছে : ‘থাকবে শাদা পানীয়, পানকারীর জন্য হবে অপার লজ্জত।’
নবীজীর বহু হাদিসেও এই রঙের পবিত্রতা মিলে : বুরাকের - যেই পশুর পিঠে করে নবীজী মিরাজ সফর করেন - তার রঙ ছিল শাদা; নবীজী বলেন : আমি বুরাকে সফর করি, ওইটার রঙ ছিল শাদা.., এইটা হাউজে কাওসারের রঙ, যেখান থেকে কেয়ামতের দিন ঈমানদারদের নবীজী পানি খাওয়াবেন : ‘আমার হাউজ হবে বরফের চাইতেও অধিক শাদা’, ‘হাজরে আসওয়াদ যখন জান্নাত থেকে নামছিল, তখন ওইটা ছিল দুধের চাইতেও অধিক শাদা’, ফেরেশতা জিবরাইল আ.-এর রঙও ছিল শাদা : ‘ভিষণ শাদা কাপড় পরা এক পুরুষ’; সারাধণ ফেরেশতারাও এমন : ‘রহমতের ফেরেশতারা নবির কাছে আসছিলেন শাদা রেশমে মুড়ায়ে।’
এমনকি নবীজী সরাসরি নির্দেশ দিছেন : তোমরা নিজেদের শাদা কাপড়টা পইরো, কারণ ওটাই তোমাদের সবচে উত্তম কাপড়। সবচেয়ে জরুরি যে, ইসলামি বিশ্বাসের রঙ শাদা— ‘আমি তোমাদের রেখে যাইতেছি এক শাদা সরল পথের উপর।’ এইখানে শাদা রঙের উচ্চ পবিত্রতা যে বলা হইল, এমন না যে, ইসলামের সাথে তুলিত হইছে শাদা, বরং ইসলামের আকিদারেই তুলনা করা হইছে শাদার সঙ্গে। অর্থাৎ, এই রঙ পবিত্রতার মতো – এমন না, বরং পবিত্রতা বলতে যা বোঝায়, সেটার রূপই হল এই রঙ।
আব্বাসিরা ও তাদের কালো বিপ্লব
আরবদের কাছে কালো বলতে এমন রঙের সব জিনিশ বোঝাত যেগুলার রঙ ঘন বা অন্ধকার; আর এইটার যাবতীয় বৈশিষ্ট্যে ছিল শাদার ঠিক বিপরীত— ইবরাহীম মোহাম্মদ আলী তার প্রাক-ইসলাম যুগের আরবি কবিতায় রঙ (১৯৯৬) বইয়ে এইটা ব্যাখ্যা করছেন। কালো রঙ আরব কালচারে জড়ায়া ছিল অসুন্দরতা, কঠোরতা আর অশুভতার সাথে; যেমন সাখাম, দাহমাশান, দুখশাম— এই রকম ইত্যাদি শব্দ আরবরা ব্যবহার করত নিন্দনীয় বা অপছন্দনীয় জিনিশ বোঝানোর জন্য। তাছাড়া কালো রঙ মন্দ কাজকর্ম আর খারাপ অনুভূতির প্রতীকী হিশেবেও পরিচিত ছিল। আরবরা বলে— কালো হিংসা, কালো জাদু, কালো ষড়যন্ত্র; আবার দুঃখ-দুর্যোগ বোঝাতে বলে— কালো দিন, কালো রাত।
এই রঙের উক্ত প্রতীকায়নক আরো জোড়াল করছে ইসলামের ধর্মীয় টেক্সট। কুফরি করা মানুশদের মুখ কালো হইয়া যাওয়ার কথা বলা হইছে আলে ইমরান সূরায় : ‘অতঃপর যাদের মুখ কালো হইয়া গেছে : তোমরা কি ঈমান আনার পর আবার অস্বীকার করছিলা?’ সূরা জুমারে বলা হইছে : ‘আপনি দেখবেন, যারা আল্লাহর উপর অপবাদ দিছিল, তাদের মুখ হবে কালো।’
নবী মুহাম্মদ স. হাদিসে কালো রঙ নিয়া সাবধান করছেন। মুসলিম শরিফের এক বর্ণনায় আছে :
‘... কালো রঙ এড়ায়া চলো।’ আরেক হাদিসে বলছেন : ‘আখেরি জামানায় একদল লোক আসবে, কালো রঙে চুল রাঙাবে, কবুতরের ঘাড়ের মতন; তারা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’
তবু, এইসব নেতিবাচক মানে থাকা সত্ত্বেও, আব্বাসিরা কালো রঙরে নিজেদের বিপ্লবী রঙ বানায়, এবং এর পবিত্রতা প্রতিষ্ঠা করে। এতটাই পবিত্র রূপ দেয় যে, আবু মুসলিম খুরাসানি— যিনি আব্বাসি বিপ্লবের প্রধান সেনাপতি— এক লোকরে হত্যা করার হুকুম দেন এই কারণেই যে, সে কালো পোশাক পরা নিয়ে ঠাট্টা করছিল; সে খুরাসানিকে জিগেশ করছিল : ‘তোমার গায়ে যে কালো কাপড় দেখতেছি, এইটা আশলে কী!’ [ইবনুল আছির, আল-কামিল ফি আত-তারিখ (১৯৮৭)]
পরবর্তীতে এই রঙরে ঘিরে এমনই পবিত্রতা রচিত হয় যে, এই নিয়ে ধর্মীয় টেক্সট ছড়ায়ে পড়ে আগের শাদা রঙ নিয়ে থাকা নুসুস-আয়াতের মতন; যেমন আব্বাসি খলিফা আবু জাফর মনসুর এক বর্ণনায় বলেন : আমি আমার বাপের কাছ থেকে শুনছি, উনি তার দাদার (আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস) কাছ থেকে শুনছেন, নবি বলছেন : ‘যখন তোমার খানদান কালো ভূমিতে (ইরাক) বাস করবে, কালো কাপড় গায়ে দিবে, আর তাদের অনুসারীরা আসবে খোরাসান থেকে — তখন ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকবে যতক্ষণ না তারা ঈসা ইবনে মরইয়মের হাতে তা ন্যাস্ত করে দিবে।’ [এই বর্ণনা পাওয়া যায় জালালুদ্দীন সুয়ুতির তারিখুল খুলাফা (২০০৪) কেতাবে।]
মনসুর ছিলেন আব্বাসি খেলাফতের আশল প্রতিষ্ঠাতা, যদিও খেলাফত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় তার ভাই আবুল আব্বাস সাফফাহ-এর হাত দিয়ে, এবং সে ছিল হচ্ছে দ্বিতীয়; কিন্তু খেলাফতের ভিত রক্ত-ঘামে গড়ছে মনসুরই। তার জামানায় যাবতীয় ক্ষমতা ছিল আব্বাসিদের করতালে, আর মনসুরের দিলদেমাগ ছিল সর্বস্তরে তার ক্ষমতা কার্যকর করায়। এইসূত্রে তার একটা স্বপ্নের কথা জানা যায় যে, সে ও তার ভাই সাফফাহ মক্কার হারামে ছিল এবং কাবার পাশে ছিলেন নবি; তার ভাইয়ের হাতে নবিজি একটা কালো নিশান দেন, এবং ওইটা দিয়ে মনসুরকে পাগড়ি পরায়ে দেন ও বলেন : ‘এ খলিফাদের পিতা, কেয়ামত তক এইটা তোমার কাছে রাইখো।’
উমাইয়া খেলাফতের শেষ দিকে মানুশের মধ্যে গুজব ছড়ায়া পড়ে— স্বপ্নে নাকি দেখা যায়, পূর্ব দিক থেকে (খোরাসান, ইরাক ইত্যাদি) কালো নিশানওয়ালা বাহিনী আসতেছে, যারা উমাইয়াদের শাদা নিশানরে হারায়া দিবে। ইমাম তবারি তার তারিখে এই নিয়ে লিখছেন যে, বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবু জাফর ঈসা বলছিলেন উমাইয়া গভর্নর নাসর ইবনে সাইয়ারকে : ‘সম্মানিত আমির, এই ক্ষমতা আর রাজত্বের পিছে আর লোভ কইরেন না, সামনে ভয়ানক সময় আসতেছে— এক অজানা বংশের লোক কালো নিশানহাতে উঠবে, আর নতুন এক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে। তখন আপনারা বেবাক তাকায়া দেখবেন, কিছুই করতে পারবেন না।’
এই সময় থেকে, আর তার পরে আব্বাসিরা, বিশেষ করে মনসুর, ব্যাপকভাবে প্রপাগাণ্ডা, গুজব, অলিক কথাবার্তা ব্যবহার করতে লাগে, নিজের পক্ষে জনমত গড়তে শুরু করে। ইতিহাসবিদ ইয়াকুবি তার তারিখে লিখতেছেন : ‘যখন যায়েদ ইবনে আলি নিহত হইলেন, তখন খোরাসানে শিয়ারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, দাওয়াতীরা (আব্বাসি প্রপাগাণ্ডিস্ট) সক্রিয় হইল, স্বপ্নগাথা ছড়াইল, আর লোকে মালহামা (শেষ জামানার যুদ্ধ) সংক্রান্ত কেতাব ঘাটাঘাটি করতে লাগল।’
আব্বাসিরা কবে কালো রঙ প্রকাশ করল?
আখবারুদ দাওলাতিল আব্বাসি্যাহ নামে একটা বই, লেখক অজ্ঞাত, ১৯৭১ সালের ছাপা, সেইখানে আব্বাস ও তার ছেলের ব্যাপারে যাবতীয় খবরাখবর আছে, সেখানে বলা হইতেছে যে, আব্বাসি আন্দোলনের প্রধান নেতা ইব্রাহিম আল-ইমাম, যে সাফফাহ ও মনসুরের ভাই ছিলেন— এই বলে ওসিয়ত রাখছিলেন : ‘কালোই হবে আমাদের জামা ও আমাদের মদদকারীদের জামা। এই রঙেই আমাদের ইজ্জত... রসুলে পাকের পতাকা ছিল কালো, আলি ইবনে আবু তালেবের পতাকাও ছিল কালো।’
কিন্তু আশল ঘটনা হল : আব্বাসিরা কালো প্রকাশ করে ইব্রাহিম আল-ইমামের মৃত্যুর পর, শোক প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ। আল-আখবারুত তিওয়াল (১৯৬০) কেতাবে দিনুরি বলেন : ‘আবু মুসলিম খোরাসানি তার সব অনুসারী নিয়ে বের হইলেন উমাইয়াদের বিরুদ্ধে, সবার পরিধেয়ে কালো জামা, তারা শোক করতেছিল উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের হুকুমে নিহত হওয়া নিজেদের শহিদ ইমামের (ইব্রাহিম) জন্য।’
ইবনে খালদুন তার তারিখের কেতাবে কালোর সাথে কোনো ধর্মীয় সম্পর্ক স্বীকার করেন নাই। বরং তিনি বলছেন : ‘আব্বাসিদের পতাকা ছিল কালো— কারণ তারা নিজের শহিদদের জন্য শোক প্রকাশ করতেছিল, আর উমাইয়াদের প্রতি প্রতিবাদ জানাইতেছিল তাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য। এই জন্য তাদের বলা হইত ‘আহলুস সোয়াদ’ বা কালো পরিধেয় দল।’
কালো উত্তোলন ও পরিধান করার মধ্য দিয়ে উমাইয়াদের প্রতি ‘আগাম শোক জানানো’র ধারণা — অর্থাৎ কালো পোশাক পরা বা কালো পতাকা তোলা — এইটা আব্বাসিদের খোরাসানে কার্যক্রম শুরু করার আগ থেকেই হাজির ছিল। এর দলিল পাওয়া যায় বিদ্রোহী খারেজিদের ইতিহাসে : ১১৯ হিজরিতে খারেজি নেতা বাহলুলের পতাকা ছিল কালো, ১২৮ হিজরিতে আবু হামযা নামক আরেক খারিজির পতাকাও ছিল কালো। এই তথ্য উল্লেখ হইছে তাবারি ও ইবনুল আছিরের তারিখে।
এইভাবে দেখা যায়, বিদ্রোহের জন্য কালো ব্যবহার হইতে হইতে, একপর্যায়ে এইটা উমাইয়াদের বিরোধিতা ও বিদ্রোহ বুঝাইতেই প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, মানে আব্বাসিরা এর উদ্ভাবক বা তাদের সাথে এইটা খাস— এরকম কিছু না। এবং এর সাথে যেসব ধর্মীয় কথা পরবর্তীতে মেলানো হয়, তা তাদের এই রাজনৈতিক কালোকে পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য দেওয়ার জন্যই আরকি।
আব্বাসিয়দের বিরুদ্ধে শাদা বিরোধিতা
আব্বাসিয় শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর, তারা যেই কালা রঙ নিজেরা বেছে নিছিল, তা নিয়ে হাসাহাসি করে বিরোধীরা। ‘খারমিয়্যাহ’ নামে এক বিদ্রোহী আন্দোলন তো সরাসরি আব্বাসিয়দের ‘কালা ধর্ম’ নামে অভিহিত করে, আর নিজেদের অভিহিত করে ‘শাদা দীন’ নামে; যেমনটা তাবারি বলছেন।
শামবাসীরাও— যারা উমাইয়াদের সমর্থক ছিল— কালো রঙকে অপছন্দ করত। ১৩২ হিজরিতে শামের কিছু শহর, যেমন দামেশক আর কিন্নাসরিন, শাদা পতাকা উত্তোলন করে, এবং আবুল আব্বাস সাফফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা জানায়। (ইবনুল আছির)আলাবিয়রাও— যারা নিজেরাও আব্বাসিয়দের মতোই বনি হাশেমের অংশ— কালা পতাকার বিরুদ্ধে শাদা রঙ বেছে নিছিল। খোরাসানের গভর্নর আব্দুল জাব্বার আযদি শাদা পতাকা উত্তোলন করে আবু জাফার মনসুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, এবং ঘোষণা দেয় যে, উনি আলাবিয়দের পক্ষে।
আরব উপদ্বীপ ও বসরাতেও ১৪৫ হিজরিতে শাদা পতাকা উত্তোলন হয়, যখন মুহাম্মদ ইবনে নাফস আয-যাকিইয়া আব্বাসিয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাবারি আমাদের জানান যে, একই ঘটনা খলিফা মামুনের শুরুর শাসনামলে আবু সারায়া’র আলাবিয় বিদ্রোহেও ঘটে।
মাসউদি মুরুজুয যাহাব কেতাবে বলেন, আব্বাসিদের বিরুদ্ধে জঞ্জ বিদ্রোহ ছিলো একটা শাদা বিপ্লব। বিদ্রোহের নেতা (আলি ইবনে মুহাম্মদ) সম্পর্কে উনি বলেন, ‘মুবাইযাদের (শাদাপন্থি) ইতিহাস ও কেতাবাদিতে জঞ্জনেতা হিশেবে তারই নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।’
একইসাথে মাসউদির লেখায় মুবাইযা ও মুসাওয়াদা— এই দুই শব্দদেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। ২৮৭ হিজরিতে তাবারিস্তানে আলাবিয় নেতা হাসান আত্রুশের অনুসারী আর আব্বাসিয়দের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, সেইটার কথা বলতে গিয়ে এই দুই শব্দ ব্যবহার করছেন মাসউদি।
এই শাদা রঙ পরে আবার কারমাতিয়ান ও ফাতেমিয়দের দ্বারা ব্যবহার হয়; আব্বাসিয় খেলাফতের জমি ভাগ করে তারা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে নেয়। (ইবনে খালদুন)
যদিও ফাতেমি ও উমাইয়াদের মাঝে কট্টর শত্রুতা ছিল, তাও উমাইয়াদের চাইতে তারা অনেক বেশি শত্রুতা রাখতো আব্বাসিয়দের সাথে, কারণ আব্বাসিরাই ছিল তখন শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, ফাতেমিদের উত্থানের সময়।
সারকথা হল, আব্বাসিদের যে-ই বিরোধিতা করতো, প্রায় সবাই শাদা পতাকা উত্তোলন করতো। আব্বাসিয়রা যদি কোনো নতুন শহরে ঢুকতো, আর দেখতো ওখানকার লোকজন কালা পতাকা তুলছে, তাহলে বুঝতো শহরটা তাদের পক্ষে আছে। আর যদি শাদা পতাকা উঠানো থাকতো, তাহলে বুঝতো যে এরা বিদ্রোহী। এই ব্যাখ্যার ব্যাপারে বহু সূত্র একমত।
সবুজ হল জান্নাতের বাগানের রঙ, জান্নাতিদের কাপড়ের রঙ। যেমন সূরা দাহরে বলা হইছে : ‘তাদের উপরে থাকবে মিহি সবুজ রেশমের ও মোটা রেশমের পোশাক।’ আর সূরা কাহফে : ‘তারা পরবে সবুজ রঙের রেশমি কাপড়’; জান্নাতে বসার আসন সম্পর্কে সূরা রহমানে বলা হইছে : ‘তারা হেলান দিয়ে বসবে সবুজ গালিচার উপর।’
এ কারণেই, সবুজ জান্নাতের প্রতীক, আর জান্নাত মানেই চিরস্থায়ীতা বা অমরত্ব। সম্ভবত এইজন্যই, সুফিরা সবুজ রঙ পছন্দ করেন, অনেকে সবুজ জামা গায়ে দেয়, ওলিদের কবর ও মাজারে সবুজ কাপড় চড়িয়ে দেয়; আহমদ মুখতার ওমর এরকম ব্যাখ্যা করছেন।
কিন্তু সবুজ ছিল আব্বাসিদের চোখে ঘৃণার রঙ, এই হিশেবে যে, এইটা ছিল আন্দালুসের উমাইয়াদের চোখের রঙ— যেইটা য়ুরোপীয় নারীদের সাথে বিয়ের কারণে তাদের হইছিল। তবু, এই ঘৃণার মাঝেও, আব্বাসি খলিফা মামুন ২০২ হিজরিতে সবুজ রঙকে রাষ্ট্রের প্রতীক বানাইতে চায়; এইটা খুবই বিপ্লবী সিদ্ধান্ত ছিল, পুরো আব্বাসি সমাজকে এইটা হতবাক করে দেয়।
এই পরিবর্তনের অংশ হিসাবে, মামুনের আরও বড় পদক্ষেপ ছিল— আলবিয় নেতা ইমাম আলি রেজার হাতে বায়াত নিয়ে মামুন তাকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন, তার নামে মুদ্রা চালু করেন, কারণ, আলি রেজাই হাশেমিদের মধ্যে সবচে সেরা। (মাসউদি)