সুলতান আল ফাতিহ: এক মহামানবের বিজয়ের ইতিহাস

আনাতোলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মুরাদ হুদাভেন্দীগার ইমাম হাতিপ লিসেসি। — বুরসা,তুর্কিয়ে

ইতিহাসসংস্কৃতি

চৌধুরী সাজিদ সাইফুল্লাহ

6/1/20251 min read

সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ—

এই নামটা বললেই যেন মনে হয়, এক নির্ভীক নেতা, এক দুর্দান্ত সেনাপতি, যিনি ইতিহাসের পাতা বদলে দিয়েছিলেন। খুব ছোট বয়সেই রাজত্বের ভার হাতে নিয়ে, তিনি এমন এক যুগান্তকারী কাজ করে দেখিয়েছেন, যা আজও পৃথিবীর ইতিহাসে দারুণভাবে জ্বলজ্বল করছে।

১৪৩২ সালের ৩০ মার্চ তুরস্কের আড্রিয়ানোপলে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ। তার পিতা ২য় সুলতান মুরাদ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী ও সফল শাসক, কিন্তু তার ছেলে আল ফাতিহ খুব দ্রুতই প্রমাণ করেন, তিনি তার বাবার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি সেনাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং তার পরের বছরেই সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হন।

প্রথমে আল ফাতিহ তার শাসনকালে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অনেক সংস্কার করেন। তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নত করতে নানা পদক্ষেপ নেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল, প্রশাসনে দক্ষ ও শিক্ষিত কর্মকর্তাদের নিয়োগ, খাজনা ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করেন। তবে, তার সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ১৪৫৩ সালের কনস্টান্টিনোপল বিজয়।

কনস্টান্টিনোপল ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী, একটি শক্তিশালী শহর, যার চারপাশে ছিল বিশাল দুর্গ। এই শহরটি জয় করার জন্য আল ফাতিহ অনেক সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি সৃষ্টিশীলতা ও কৌশল ব্যবহার করে একটি নতুন প্রকারের বড় তোরণ বানান, যা দিয়ে শহরের দুর্গ ভাঙা সম্ভব হয়। তার সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, এবং আল ফাতিহের নেতৃত্বে তারা ৫৩ দিন ধরে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত শহরটি জয় করে।

কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর, সুলতান আল ফাতিহ শহরটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইস্তানবুল’ রাখেন, এবং ইসলামি সাংস্কৃতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তিনি মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি বিদ্যাপীঠও স্থাপন করেন। একদিকে যেমন তিনি ধর্মীয় কাজগুলো গুরুত্ব দিয়েছেন, অন্যদিকে শাসন ও প্রশাসনের কাজও সুচারুরূপে করেছেন। আল ফাতিহ শুধু একজন সৈন্যনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দার্শনিক, সংস্কৃতিপ্রেমী, এবং বিজ্ঞানমনস্ক শাসক। তার শাসনকালে নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, দর্শন ও সাহিত্যচর্চা বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল। তিনি নিজের দরবারে বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন।

সুলতান আল ফাতিহের শাসন ছিল এক যুগান্তকারী সময়, যা তুর্কি, ইসলামিক, এমনকি সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসের জন্য এক বিরাট দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। তার অসীম সাহস, কৌশল, এবং বিচক্ষণতা তাকে ইতিহাসে একটি অমর স্থান দিয়েছে। ১৪৫৩ সালের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের মধ্য দিয়ে সুলতান আল ফাতিহ শুধু একটি শহর জিতেননি, বরং নতুন এক যুগের সূচনা করেন। তার জীবন ছিল সংগ্রামের, বিজয়ের, এবং এক মহামানবের গল্প, যা আজও আমাদের প্রেরণা দিয়ে যায়।

তিনি ১৪৮১ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন, এবং তার মৃত্যু সাম্রাজ্যের জন্য এক বিরাট ক্ষতি ছিল। তবে তার শাসনকাল ও অর্জন আজও ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে।

সুলতান আল ফাতিহের মাজারটি ইস্তানবুলের ফাতিহ অঞ্চলে অবস্থিত। মাজার প্রতিষ্ঠা করেন তারই পুত্র সুলতান দ্বিতীয় বেয়াজিত।