ইসলামী ক্যালিগ্রাফি

সংস্কৃতিইতিহাস

মুহাম্মদ হুযাইফা

6/1/20251 min read

ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি হল একটি জীবন্ত শিল্পকলা যা আরবি ভাষার লিখিত রূপকে ব্যবহার করে। এটি ইসলামী শিল্প ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং এটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে শতাব্দী ধরে অনুশীলন করা হয়ে আসছে। এর সৌন্দর্য, অঙ্কন রীতি, উপস্থাপনা ও নিটোল লিপিশৈলী যেকোনো মানুষকে আত্মমুগ্ধ করে। মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফি গৌরবময় শিল্প

ক্যালিগ্রাফি

ক্যালিগ্রাফি এমন শিল্পকে বলা হয়, যাতে বিস্ময়কর সব অক্ষরবিন্যাস , শব্দ, প্রতীক ইত্যাদিতে সাজানো হয়। শব্দ ও হরফের নানা বাঁক সৃষ্টির দক্ষতা, কৌশল ও সৃজনশীল নকশা ক্যালিগ্রাফির মূল আকর্ষণ। এ কারণে গবেষকরা আরবি ক্যালিগ্রাফিকে ‘লিভিং আর্ট’ বা জীবন্ত শিল্পকলা বলে অভিহিত করেছেন। আরবি বর্ণমালাকে কেন্দ্র করে ইসলামি লিপিকলার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ। আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি, আরবি লিপি-বর্ণ হরফ-জের-জবর-পেশের সঙ্গে মুসলমানদের আলাদা আবেগ-অনুভূতি মিশে আছে। অন্যদিকে ইসলামে মানুষ কিংবা প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই লিপিকলানির্ভর অলংকরণশৈলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

ক্যালিগ্রাফি- শব্দ-

ইংরেজি ক্যালিগ্রাফি শব্দটি গ্রিক ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে এসেছে। গ্রিক শব্দ ক্যালোস এবং গ্রাফেইনের মিলিত রূপ ক্যালিগ্রাফিয়া। ক্যালোস অর্থ সুন্দর, আর গ্রাফেইন অর্থ লেখা। সহজে ক্যালিগ্রাফির পরিচয় এমন, ‘বর্ণ বা শব্দ ব্যবহার করে চমৎকার লিখনশিল্পকে ক্যালিগ্রাফি বলে।

ইতিহাস

ধারণা করা হয়, ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার বর্ণমালা সভ্যতার শুরু থেকেই। তবে সবাই এটা স্বীকার করেন, ক্যালিগ্রাফিকে সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যাওয়ার পেছনে আরবদের অবদান সবচেয়ে বেশি। ইসলামপূর্ব সময়ে মক্কায় আরবি লিপি প্রথম প্রচলন করেন বিশর ইবনে আবদুল মালিক আল কিন্দি। তিনি উত্তর আরবের হীরা এবং আনবার অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে ‘নাবাতিয়ান’ লিপি লেখার শৈল্পিক জ্ঞান অর্জন করেন। প্রাচীন তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, আরবরা ইসলামের আগে থেকেই আরবি লিপিতে লেখালেখি করত। এ ছাড়া সে সময় ইহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের বইপত্র হিব্রু এবং ‘সিরিয়াক’ লিপির সঙ্গে আরবিতেও লিখত।

  • ক্যালিগ্রাফি চর্চার শুরু

নবম শতাব্দীর প্রথমভাগে ইবনে মুকলাহ ক্যালিগ্রাফি (আল-খত-আল মানসুব) নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা এবং বিজ্ঞানসম্মত কিছু নিয়মনীতি চালু করেন। তিনি হরফের বিন্যাসকে পরিমাপ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন। ইবনে মুকলাহ ক্যালিগ্রাফিতে ছয়টি মৌলিক রীতি প্রবর্তন করেন। ১. কুফি, ২. নাসফি, ৩. ওয়াহানি, ৪. তাওকি-রিকা, ৫. সুলুস ও ৬. ফারসি। তিনি আরবি বর্ণবিন্যাস থিওরি দেন। যার কয়েকটি হলো ক. আরবি বর্ণমালার ২৯টির মধ্যে ১৯টি মূল অক্ষর। যার ওপর নির্ভর করে বাকি অক্ষর বিন্যস্ত হয়। অক্ষরসমূহ হলো আলিফ, বা, হা (হুত্তি), দাল, রা, সিন, সোয়াদ, ত্বোয়া, আইন, ফা, ক্বাফ, কাফ, লাম, মিম, নুন, ওয়া, হা (হাওয়াজ), হামজা ও ইয়া। খ. আলিফ অক্ষরকে একক আকৃতি ধরে অন্যান্য বর্ণ লেখা, গ. শব্দের মধ্যকার ফাঁক একই রকম দূরত্বে রাখা, ঘ. দুই লাইনের মধ্যকার পার্থক্য একই মাপের থাকা, ঙ. অক্ষরে ঊর্ধ্বরেখার কৌণিক বিস্তৃতি যথাযথ বিবেচনায় রাখা ও চ. কলমের নিবের প্রশস্ততা পরিমিতভাবে ব্যবহার করা। ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রে এমন সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ইবনে মুকলাহকে ক্যালিগ্রাফি বা লিপিকলার জনক বলা হয়।

  • ক্যালিগ্রাফির নান্দনিক প্রয়োগ

মধ্যযুগের মুসলমানরা নানা রকম ব্যবহার্য জিনিসপত্রে লিপিকলার নান্দনিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত উসমানীয় আমলের তলোয়ার, পঞ্চদশ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত লোহার শিরস্ত্রাণ, দ্বাদশ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত ব্রোঞ্জের দর্পণ, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিসর অথবা সিরিয়ায় নির্মিত সোনা ও রুপার প্রলেপ দেওয়া পিতলের গামলা, চতুর্দশ শতাব্দীতে স্পেনের গ্রানাডায় তৈরি রেশম কাপড় এবং ষোড়শ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত বিভিন্ন অলংকারের সাক্ষ্য বহন করছে। এ সময়ে ধাতব মুদ্রাতেও ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করা হয়েছে।

  • অন্যান্য আরবী ক্যালিগ্রাফি নসখ

আরবি ক্যালিগ্রাফির মূল পাঁচটি স্টাইল। তা হলো নাশখ, নাস্তালিক, দিওয়ানি, তুলুত ও রুকআহ। এ ছাড়া আরবি ও ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে বহুল ব্যবহৃত ফন্টের মধ্যে আছে : সুলুক, নাশখ, দিওয়ানি, তালিক, ফারসি, ইজাজা, কারামাতিয়ান কুফি, ইস্টার্ন কুফি, মাগরেবি কুফি, আন্দালুসিয়ান কুফি, বিহারি, বেঙ্গল তুগরা (সুলুক, নাশখ), রায়হানি, মুহাক্কাক, জালি সুলুস, জালি দিওয়ানি ইত্যাদি। অন্যদিকে আরবি ও ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে বহুল ব্যবহৃত কলমকে বলে ‘কলম খাশাব’ ও ‘কলম বুস’।

  • চতুর্থ খলিফা

চতুর্থ খলিফা ও ক্যালিগ্রাফির মহান উস্তাদ হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে বলেন, ‘আল-খত্ মুখফিউন ফি তালিমিল উস্তাজি ওয়া কওয়ামুহু ফি কাসরাতিল মাশকি ওয়া দাওয়ামুহু’ অর্থাৎ ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে রহস্যময়, উস্তাদের শিক্ষার মাধ্যমে তা উন্মোচিত হয় আর অধিক অনুশীলন এবং লেগে থাকার মাধ্যমে তা আয়ত্তে আসে।

  • ক্যালিগ্রাফির ভবিষ্যৎ

ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে হয়। নতুন প্রজন্মের ক্যালিগ্রাফাররা এই শিল্প রূপকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে, এবং এটি বিশ্বব্যাপী আরও বেশি লোকের কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছেইসলামিক ক্যালিগ্রাফি হল একটি জীবন্ত শিল্পকলা যা আরবি ভাষার লিখিত রূপকে ব্যবহার করে। এটি ইসলামী শিল্প ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং এটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশে শতাব্দী ধরে অনুশীলন করা হয়ে আসছে। এর সৌন্দর্য, অঙ্কন রীতি, উপস্থাপনা ও নিটোল লিপিশৈলী যেকোনো মানুষকে আত্মমুগ্ধ করে। মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফি গৌরবময় শিল্প।